খোকন আহম্মেদ হীরা: মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানেই সফলতার মুখ দেখতে শুরু করেছেন সুলতান হোসেন। বর্তমানে অনেক বেকার যুবক সুলতানের কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে খাঁচায় মাছ চাষ (বায়োফ্লক) শুরু করার প্রস্তুতি নিয়েছেন। তবে তরুন উদ্যোক্তাদের দাবি, সরকারীভাবে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া গেলে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে দেশীয় মাছ চাষ করে তারা কর্মসংস্থানের সুযোগ পাবেন।
বরিশালের বানারীপাড়া উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা সুলতান হোসেন পতিত জমিতে বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করে মাত্র ছয় মাসের ব্যবধানে সফলতা অর্জন করে পুরো জেলাজুড়ে ব্যাপক আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন। তিনি নিজ এলাকার কম খরচে অন্যের পতিত জমি বার্ষিক চুক্তিতে লিজ নিয়ে বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে দুটি ট্যাঙ্কি তৈরি করে স্থানীয় জাতের শিং, কৈ, মাগুর, পাবদা, সিলন ও ট্যাংরা জাতের মাছ চাষ শুরু করেছিলেন। সুলতান হোসেনের বায়োফ্লোক পদ্ধতির মাছ চাষ দেখে স্থানীয় যুবকরা তার কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে বাড়ির পতিত জায়গায় মাছ চাষের উদ্যোগ নিয়েছেন। সফল উদ্যোক্তা সুলতান হোসেনও তার কাছে পরামর্শ নিতে আসা বেকার যুবকদের বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ করছেন।
স্থানীয় বেকার যুবক মনির হোসেন বলেন, বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে সুলতান হোসেনের মাছের খামার দেখে তিনিসহ স্থানীয় অনেক বেকার যুবকরাই অনুপ্রাণিত হয়েছেন। কিন্তু প্রথমপর্যায়ের ব্যয়ভার বহন করা তাদের জন্য দুস্কর হয়ে পরেছে। এজন্য তারা বিভিন্ন ব্যাংকে ঋণ নেয়ার জন্য যোগাযোগ করেছেন। তবে ব্যাংকগুলো ঋণ দেওয়ার নামে নানা কাগজপত্র চেয়ে সময় ক্ষেপণ করে তাদের হয়রানি করায় বেকার যুবকদের উৎসাহে ভাটা পরছে। তিনি আরও বলেন, সরকারীভাবে সহজ শর্তে ঋণ পাওয়া গেলে বায়োফ্লক পদ্ধতিতে দেশীয় মাছ চাষ করে সারাদেশের বেকার যুবকরা কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারবেন।
সফল উদ্যোক্তা সুলতান হোসেন বলেন, গত ছয় মাস পূর্বে তিনি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে খাঁচায় মাছ চাষের বায়োফ্লক পদ্ধতি দেখে দেশি মাছ চাষে উদ্বুদ্ধ হন। ইন্দোনেশিয়া ও ভারতের যৌথ পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে তিনি এ পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু করেন। প্রথমে তিনি অন্যের পতিত জমি অল্পমূল্যে বাৎসরিক চুক্তিতে লিজ গ্রহণ করেন। পরে “এসএইচ ফিশ ফার্ম ইন বরিশাল” নামে পৃথক দুটি খাঁচা তৈরি করে পরীক্ষামূলকভাবে তিনি মাছ চাষ শুরু করেন। এখন তার চারটি খাঁচা রয়েছে। গত কয়েকদিন পূর্বে তিনি ৬০ হাজার টাকার মাছ বিক্রি করেছেন। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তিনি তার অনান্য খাঁচার মাছ বিক্রি করবেন। সুলতান হোসেন আরও বলেন, বর্তমানে তার খাঁচায় যে মাছ রয়েছে তাতে তিনি প্রায় দুই লাখ টাকার শিং মাছ, এক লাখ টাকার কৈ মাছ, এক লাখ টাকার তেলাপিয়া, এক লাখ টাকার ট্যাংরা এবং দুই লাখ টাকার পাবদা মাছ বিক্রি করতে পারবেন।
বয়োফ্লোক পদ্ধতি সম্পর্কে সুলতান হোসেন বলেন, পতিত কিংবা খোলা জায়গায় ৩৫ ফুট লম্বা রড ছয় থেকে সাত ইঞ্চি পরপর ঝালাই করে সাড়ে তিন ফুট উঁচু এবং ১০ ফুট গোলাকৃতির একটি খাঁচা তৈরি করতে হয়। পরে ওই খাঁচা একটি ওয়াটার প্রুফ ত্রিপল দিয়ে ভালো করে আটকাতে হয়, যাতে কোনোভাবে খাঁচার পানি বাহিরে বের হতে না পারে। খাঁচার নিচের দিকে ছিদ্র করে পানি প্রবেশ ও বের করার জন্য লোহা বা প্লাস্টিকের একটি পাইপ এবং সুইচ সংযুক্ত করা হয়েছে। পরে মোটর দিয়ে খাঁচায় প্রয়োজনীয় পানি ও অক্সিজেনসহ অন্যান্য উপকরণ দেওয়ার পর সেখানে মাছ চাষ করতে হয়।
তিনি আরও বলেন, প্রতিটি খাঁচা তৈরি করতে তার ২৫ হাজার টাকা করে খরচ হয়েছে। প্রত্যেকটি খাঁচায় পাঁচ হাজার করে শিং, কৈ ও তেলাপিয়া এবং একটিতে মাগুর, পাবদা, সিলন ও ট্যাংরা মাছের ২০ হাজার করে পোনা ছাড়া হয়েছে। একটি খাঁচায় বছরে দুই থেকে তিনবার মাছ চাষ করা সম্ভব। এতে মাছের উৎপাদন বেশি হওয়ায় লাভও বেশি হয়। এ পদ্ধতিতে মাছের খাবার কম লাগে এবং অসুখ না হওয়ায় চাষীকে আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়না।
মাছ চাষের পদ্ধতি সম্পর্কে সুলতান হোসেন বলেন, মাছ চাষের আগে প্রতিটি খাঁচায় চুন, লবণ, চিটাগুড় ও প্রবাইটিক দিয়ে সাত দিন পর্যন্ত পানির কালচার (মিশ্রণ) করতে হয়। এরপর খাঁচায় স্থানীয় জাতের শিং, কৈ, মাগুর, পাবদা, সিলন ও ট্যাংরা মাছ চাষ করা যায়। প্রতিটি খাঁচার মধ্যে মাছের সাইজ অনুযায়ী পরিমিত খাবার দিতে হয়। প্রতি তিন থেকে চার মাস পর একটি খাঁচায় সাত থেকে আটমণ মাছ উৎপাদন করা যায়। যা স্থানীয় বাজারে বিক্রি করে বিপুল পরিমাণ টাকা আয় করা সম্ভব।
সফল চাষী সুলতান হোসেন বলেন, তার এ পদ্ধতির মাছ চাষের বিষয়টি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল হওয়ার পর অসংখ্য বেকার যুবকরা বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষে আগ্রহী হয়ে তার সাথে যোগাযোগ করছেন। ইতোমধ্যে বরিশালসহ ঢাকা, রাজশাহী ও বাগেরহাট থেকে শতাধিক বেকার যুবকরা তার (সুলতান) বাড়িতে এসে হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়েছেন। তিনিও সবাইকে বিনাপয়সায় প্রশিক্ষণ দিচ্ছেন। এছাড়া মাছ চাষের জন্য খাঁচা তৈরি করতেও তিনি সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন।
অতিসস্প্রতি উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ আব্দুল্লাহ সাদীদ, কৃষি কর্মকর্তা ওলিউল আলম ও মৎস্য কর্মকর্তা জামাল হোসেন কৃষ্ণপুর গ্রামের সুলতান হোসেনের বায়োফ্লোক পদ্ধতির মাছের খামার পরিদর্শন করে এ উদ্যোগের ভূয়সী প্রশংসা করেন। উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা জামাল হোসেন বলেন, বাংলাদেশে এখনও বাণিজ্যিকভাবে বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ শুরু হয়নি। পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় বায়োফ্লোক পদ্ধতি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছে। এছাড়া গাজীপুরেও পরীক্ষামূলকভাবে বায়োফ্লোক পদ্ধতিতে মাছ চাষ হচ্ছে। বানারীপাড়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার শেখ আব্দুল্লাহ সাদীদ বলেন, প্রতিটি গ্রামের বেকার যুবকরা সুলতান হোসেনের মতো নতুন পদ্ধতিতে মাছ চাষে এগিয়ে আসলে এদেশে আর বেকার থাকবেনা। পাশাপাশি দেশীয় জাতের মাছের উৎপাদনও বৃদ্ধি পাবে। জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আবু সাইদ বলেন, বায়োফ্লক পদ্ধতিতে মাছ চাষ লাভজনক হওয়ায় তা চাষী পর্যায়ে পৌঁছে দেওয়ার বিষয়ে সংশ্লিষ্ট উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সাথে কথা হয়েছে। যত দ্রুত সম্ভব এ চাষের উদ্যোক্তাদের পর্যাপ্ত সহায়তা করা হবে।