• মার্চ ২৮, ২০২৩
  • Last Update ফেব্রুয়ারি ১১, ২০২৩ ৯:১৫ অপরাহ্ণ
  • বাংলাদেশ

ববি ভিসির বিরুদ্ধে বিস্তার অভিযোগ ॥ প্রতিবাদী টুর্নামেন্ট

ববি ভিসির বিরুদ্ধে বিস্তার অভিযোগ ॥ প্রতিবাদী টুর্নামেন্ট

স্টাফ রিপোর্টার, বরিশাল ॥ চলমান আন্দোলনের ২৫দিনে শনিবার সকালে বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (ববি) উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হকের বিরুদ্ধে বিস্তার অভিযোগ তুলে ধরেছেন শিক্ষার্থীরা। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালনের সময় ভিসির বিরুদ্ধে নানা অনিয়ম ও লুটপাটের অভিযোগ করেন।

এর আগে ভিসি’র পদত্যাগের দাবিতে শুক্রবার বিকেলে ব্যতিক্রমী প্রতিবাদী ক্রিকেট টুর্নামেন্ট অনুষ্ঠিত হয়। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি লোকমান হোসেন জানান, প্রতিবাদী ক্রিকেট টুর্নামেন্টে আটটি দল অংশগ্রহণ করেন। শিক্ষার্থীরা দলগুলোর নাম রেখেছে-হক বাবা রাইডার্স, হাসিনুর হারিকেন্স, দালাল ডায়নামাইট, ভিসি ভ্যাম্পায়ারস, ইমামুল ভাইকিন্স, বুইড়া বুলস, রেজিষ্ট্রার ব্লাক ক্যাপস এবং অবাঞ্চিত ডেভিলস। ববি’র খেলার মাঠে নকআউটভিত্তিক শর্ট পিস টুর্নামেন্ট শেষে কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে অবস্থান কর্মসূচি পালন করে শিক্ষার্থীরা।

এদিকে শনিবার সকালে ক্যাম্পাসে অবস্থান কর্মসূচি পালনকালে শিক্ষার্থীদের প্রতিনিধি লোকমান হোসেন অভিযোগ করেন, ববি’র ভিসি এসএম ইমামুল হক সপ্তাহের দুইদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ফরাসি ভাষা শিক্ষা বিভাগে ক্লাস নেন। টাঙ্গাইলের মাওলানা ভাষানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট সদস্য হওয়ায় মাসে তিনি দুইবার ববি’র গাড়ি নিয়ে সেখানে যাতায়াত করেন। এছাড়াও বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রশ্নপত্র মডারেশন ও নিয়োগ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন। এর বিনিময়ে তিনি সব যায়গা থেকেই নিয়মিত থাকা এবং খাবারের (টিএ/ডিএ) পাশাপাশি ও সম্মানীভাতা নিয়ে থাকেন। তার পরেও ঢাকায় বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজের অজুহাত দেখিয়ে তিনি (ভিসি) প্রতিমাসে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার টাকার টিএ/ডিএ তুলে নিয়েছেন।

বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, উপাচার্য অধ্যাপক ড. এসএম ইমামুল হক ২০১৭ সালের অক্টোবর মাসে টিএ/ডিএ বাবদ ৩২ হাজার ৮৩০ টাকা তুলে নিয়েছেন। ওই মাসে তিনি স্নাতক শ্রেণির ভর্তি পরীক্ষার গোপনীয় কাজ সম্পাদনের জন্য ঢাকায় ১২দিন অবস্থান করে খাবার বাবদ ২১ হাজার ৮৪০ নিয়েছেন। অথচ ঢাকাস্থ লিয়াজোঁ অফিসের সকল খাবারের খরচ বরিশাল বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকায় সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এছাড়াও বিভিন্ন অযুহাতে তিনি ভর্তি পরীক্ষার বৃহত অংকের টাকা নিয়েছেন। ওইবছরের পরীক্ষার হিসেব বিশ্ববিদ্যালয়ে জমা না দেওয়ায় এ ব্যাপারে কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। একইভাবে তিনি গত বছরের জানুয়ারি মাসে ৫৬ হাজার ৭১২ টাকা টিএ/ডিএ তুলে নিয়েছেন।

এক গাড়ির তিন চালক ॥ মোহাম্মদ শাহ জালাল ২০১৭ সালের ১ নভেম্বর চালক পদে নিয়োগ পেয়েছেন। সেই থেকে অদ্যবর্ধি কেউ তাকে বিশ্ববিদ্যালয়ে দেখেননি। আর দেখবেনই বা কীভাবে? তিনি উপাচার্যের চালক হিসেবে নিয়োগ পেলেও ঢাকায় তার (ভিসি’র) স্ত্রীর গাড়ি চালিয়ে থাকেন। এছাড়া উপাচার্যের চালক হিসেবে আরও দুজন চাকরি করছেন। চালক শাহীন শিকদার বরিশালে গাড়ি চালান। আর ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসে তোফায়েল হোসেন। এভাবেই একটি গাড়ির কাগজপত্রে তিনজন চালক কর্মরত রয়েছেন।

উপাচার্য নিয়মিত আকাশপথে ঢাকা-বরিশাল যাতায়াত করলেও তার ব্যবহৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের পাজেরো গাড়িটি জ্বালানি পুড়িয়ে খালি অবস্থায় আসা-যাওয়া করে। পাশাপাশি উপাচার্যের তিনজন গাড়ি চালকের পেছনে বিশ্ববিদ্যালয়ের মাসে প্রায় ৮০ হাজার টাকা ব্যয় হচ্ছে। তাদের প্রত্যেকের বেতন, অতিরিক্ত দায়িত্বভাতা এবং অতিরিক্ত কাজের জন্য পারিশ্রমিক হিসেবে এ টাকা নিচ্ছেন। অতিরিক্ত অর্থের এই অপচয়ের ব্যাপারে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ অবগত থাকার পরেও অপচয়রোধে কোনো কার্যকরি ব্যবস্থা নিচ্ছেন না।

পরিবহন পুলের ম্যানেজারের দায়িত্বে থাকা মার্কেটিং বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেহেদী হাসান বলেন, উপাচার্য এবং প্রকল্প পরিচালকের জন্য দুটি গাড়ি বরাদ্দ রয়েছে। উপাচার্যের গাড়িটি অধিকাংশ সময় ঢাকার লিয়াজোঁ অফিসে থাকে। তখন উপাচার্য মহোদয় প্রকল্প পরিচালকের গাড়িটি বরিশালে ব্যবহার করেন। চালক শাহ জালালের ব্যাপারে মেহেদী হাসান বলেন, উপাচার্য ব্যাক্তিগত কাজে ব্যবহারের জন্য একটি গাড়ি পাবেন। সে অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনে অর্থ বরাদ্দ চাওয়া হয়েছে। কিন্তু সেই অর্থ এখন পর্যন্ত পাওয়া যায়নি। তবে আগেভাগেই তার ব্যক্তিগত গাড়ি চালক শাহ জালালকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। জালাল ঢাকাতেই উপাচার্যের ব্যক্তিগত গাড়ি চালান।

ছোট কেনাকাটায় বড় অনিয়ম ॥ রসায়ন বিভাগের ল্যাব স্থাপনের জন্য পানি ও গ্যাসের লাইনের জন্য ২০১৭ সালের ২০ জুলাই আলাদা আলাদা কোটেশন দাখিল করা হয়। বিলটি যাচাই-বাছাই করে দেখা গেছে, যারা কোটেশন দাখিল করেছেন তারা সকলেই সরবরাহকারী। দাখিলকৃত কোটেশনে কোনো তারিখ নেই। ওই কাজের জন্য তাদের কোনো অভিজ্ঞতা নেই। এমনকি ছিল না বৈধ ও হালনাগাদ কোনো কাগজপত্র। আলাদা কোটেশন দাখিল করা হলেও টেন্ডার মূল্যায়ন কমিটি দুটি কাজকে একত্রিত করে কার্যাদেশ প্রদান করেছেন। ওই বছরের ৩ আগস্ট উপাচার্যের অনুমোদনসাপেক্ষে সরকারী ক্রয়নীতি ভেঙে কার্যাদেশ দেওয়া হয়েছে। কিন্তু বিল দাখিলের সময় ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি আলাদা আলাদাভাবে দাখিল করেছেন।

জনৈক সাইদুল করিমের মালিকানাধীন ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান বরিশাল সদর উপজেলার জাগুয়া ইউনিয়নের মেসার্স ইসাম বিল্ডার্স। ২০১৭ সালের ৭ আগস্ট ১৫৯ নম্বর ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে তিনি বিল দাখিল করেছেন। রসায়ন বিভাগের ল্যাবের ২ লাখ ৪৩ হাজার ৬৬৯ টাকা ব্যয়ে সিভিল ওয়ার্কের কাজ করেছে একই ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান। সেখানে ২০১৭ সালের ২৬ জুলাই ১৫৬ নম্বর ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে বিল দাখিল করেছেন। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দুটি লাইসেন্সই ভুয়া। সাইদুল করিম মূলত এলজিইডির তৃতীয় শ্রেণির একজন ঠিকাদার।

রসায়ন বিভাগের ল্যাবে ২ লাখ ২১ হাজার ৬৫৮ টাকা ব্যয়ে কাঠের কাজ পেয়েছেন ঢাকার ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান চারুলতা ইনটেরিয়ার ডেকোরেশন। প্রতিষ্ঠানটি ২০০৪ সালের ১৯ জুলাই ঢাকা সিটি কর্পোরেশন কর্তৃক ইস্যুকৃত (১০৭১৮৯) ট্রেড লাইসেন্স দিয়ে ২০১৮ সালের ৪ ফেব্রুয়ারী বিল দাখিল করেছে। তবে হিসেব শাখা থেকে একই বছরের ২০ মার্চ আপত্তি দাখিলের পর ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানটি তড়িঘড়ি করে উক্ত লাইসেন্সটি নবায়ন না করে একই নামে বাকেরগঞ্জ পৌরসভা থেকে ওই বছরের ১৬ এপ্রিল একটি ট্র্রেড লাইসেন্স জমা দেয়।

কাঠের কাজের ওই বিলটি যাচাই করে আরও দেখা গেছে, ইয়াসিন স্টোর নামের একটি প্রতিষ্ঠান কাঠের কাজটি করার জন্য ২ লাখ ৫৪ হাজার ৩১২ টাকার একটি কোটেশন দাখিল করেছে। যার ট্রেড লাইসেন্সে ব্যবসায় ধরন চায়ের দোকান উল্লেখ রয়েছে। বিলটি নিয়ে হিসেব শাখা আপত্তি দাখিলের পরেও ২০১৮ সালের ১ জানুয়ারি উপাচার্য রহস্যজনক কারনে বিলটির অনুমোদন দিয়েছেন। একইভাবে পদার্থবিজ্ঞান, মৃত্তিকা ও পরিবেশবিজ্ঞান, গণিত, খনিবিদ্যা, কম্পিউটার সায়েন্স, উদ্ভিদবিজ্ঞান বিভাগে স্থাপিত ল্যাবেও সরকারী ক্রয়নীতি অনুসরণ না করে লাখ লাখ টাকার কার্যাদি সম্পন্ন করা হয়েছে।

অর্থ ও হিসাব শাখার উপ-পরিচালক সুব্রত কুমার বাহাদুর বলেন, টিএ/ডিএ বিল একান্তই ব্যক্তিগত বিষয়। উপাচার্য যথযিথ কাগজ জমা দিয়েই বিল তোলেন। তাছাড়া উপাচার্য বিল দিলে তা পরিশোধ করতে আমরা বাধ্য। সরকারী ক্রয়নীতি অনুসরণ করে ২৪টি বিভাগের সকল কাজ করা সম্ভব নয়। এ কাজ করতে গিয়ে আমাদেরও কিছু ভুল হতে পারে। তবে সেই ভুল ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নির্দেশেই আমরা করতে বাধ্য হচ্ছি। আন্দোলনরত শিক্ষার্থীরা এসব অভিযোগের গভীর তদন্তের জন্য দুর্নীতিদমন কমিশনের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।

উল্লেখ্য, ভিসি’র পদত্যাগের দাবিতে গত ২৫দিন পর্যন্ত শিক্ষার্থীরা ও গত ছয়দিন থেকে শিক্ষক, কর্মকর্তা ও কর্মচারীরা আন্দোলন কর্মসূচি পালন করে আসছেন।

Related Articles

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *